
বাপের একমাত্র আদরের মেয়ে পৃথিবী। মা মরা এই সন্তানটির বাবা কখনোই বুঝতে দেয় নি মায়ের অভাব। প্রথমে অতি আদুরে সন্তানকে নিয়ে বাবা একটু ভাবনায় পড়েছিল। কিন্তু আজ কিছুটা হলেও ভাবনা তার কেটে গেছে। বাড়ি, গাড়ি, জমি-জমা, বিষয়-সম্পত্তি সবই তার আছে। তাই মেয়েটিকে উন্নত আসনে আসীন করাই এখন কাসেম সাহেবের একমাত্র ল্য। গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে পৃথিবী এখন আযিযুল হক কলেজে অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী।
কাসেম সাহেবের স্ত্রী একজন গুণী মানুষ ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে স্বামীর পাওয়া জায়গা জমিতে গড়ে তুলেছে আম, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল বাগান আরো কত কি! বিস্তীর্ণ একটি পুকুর, সান বাঁধানো ঘাট, পুকুর পাড়ে দেবদারু, ইউক্যালিপটাস, কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলি তার হাতের নিপুণতার সাী বহন করে চলেছে যেন। শীতের দিনে স্নানপূর্ব মানুষের ভীড় মাঝে মধ্যে তার অন্তরে পীড়ার উদ্রেক করে। কিন্তু পরণেই স্থানে স্থানে মানুষের আনন্দ বিচরণ তার সে পীড়াকে ম্লান করে দেয়। বাগানের এক ধারে তার পুরাতন বাড়ির নতুন সংস্কার কাসেম সাহেবের পারিবারিক ঐতিহ্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে শত গুণ। সন্তান না থাকায় অনেক পীর-ফকিরের আস্তানায় গিয়েছিল তারা। অবশেষে যখন সন্তান সম্ভবা তখন আনন্দের আর সীমা থাকে না তাদের। স্বামীর কাছে তার অনেক আবদার- প্রজন্মের নাম কী হবে, তোমার মতো হবে না আমার মতো হবে, ফুটফুটে চাঁদের মতো অথবা জ্বলজ্বলে নত্র ইত্যাদি। কাসেম সাহেব হাসেন আর মাথা নাড়েন। অবশেষে সন্তানটি যখন ধরণীর আলো দেখতে এলো সেদিন এই পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে অনেক দূরে চলে গেল রহিমা। যেখানে যাওয়া যায় অথচ ফিরে আসা যায় না। প্রকৃতির লীলায় কাসেম সাহেবই আজ সন্তানটির মা ও বাবা। আদরের আতিশয্যে তার নাম দিয়েছে ‘পৃথিবী’। কারণ অন্তরীরে হাসি-কান্না, নিরবতা-দুর্বলতা সবই তো তার সন্তানকে নিয়ে।
অর্ণব, রাহী এবং পৃথিবী একই ইয়ারের শিার্থী। নোট করা, বই পড়া আর পরীার প্রস্তুতি সবই তাদের একই সূত্রে গাঁথা। শালীনতা, নম্র, ভদ্র, বিনয়, সব কিছুতেই যেন তিনজন একে অপরের তুলনায় অধিক। এমন ত্রয়ী সুমিল অনেকটাই দুর্লভ।
যখন অনার্স পড়তাম তখন কাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধু-বান্ধবী মিলে ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতাম। বন্ধু মোমিন বলত, তোরা দেখতো বৃরে নিচে ঐ যুগলবন্দী ছাত্র-ছাত্রী কেমন নির্লজ্জ। ওদের সাথে হাই ওয়ান আর মানুষের তফাৎ কি? ওর কথা শুনে আমরা সমস্বরে হেসে উঠতাম। পরিচয় সৃষ্টির লক্ষে ছেলে মানুষ মেয়েদের বন্ধু হয়। প্রথমে শুধু বন্ধু, তারপর কিছুদিন একসাথে ফ্রি স্টাইল পথ চলা। তারপর মন, তারপর চোখ, তারপর হাত, তারপর …………….। এমনি করে সেভ বন্ধু থেকে কেউ হারায় সম্ভ্রম, কেউ হারায় সদ্য বিবাহিত স্বামী, কেউ হয় উদাসীন, কেউ বা হারিয়ে যায় জীবন থেকে অনেক দূরে। আড্ডায় মাতিয়ে কিছু মেয়ে জীবনে উন্নতি লাভ করে নি এমন নয়। কারণ- ছেলেমেয়ে আড্ডা শেষে মেয়েটি যখন রুমে ফিরে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে মুষলধারে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে আর মন মস্তিষ্ক ঠোঁটে উচ্চারণ করে চলেছে, “যে বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন দান ঘটে তাকে জারণ বলে, পান্তরে যে বিক্রিয়ায় ইলেকট্রন গ্রহণ ঘটে তাকে বিজারণ বলে।” তখন ছেলেটির কামনার দুটি চোখ সফেদ ছাদ ভেদ করে আলেয়ার আলোয় দেখতে পাচ্ছে সুন্দর প্লাক করা ভ্রু, V আকৃতির সিথি, এলিট মেহেদির সুরেলা পাতার আল্পনা আরো কত কি? তাই তো পরীার সময় মেয়েটির রেজাল্ট A গ্রেড ছেলেটির রেজাল্ট ………….।
অর্ণব এবং রাহী পৃথিবীকে নিয়ে ভাবে কিনা জানি না। তবে তাদের রেজাল্ট মন্দ নয়। থার্ড ইয়ার পরীা শেষে সুন্দরবন সফর করেছে তারা একসাথে। কাসমেটরাও ছিল। অর্ণব ধনী বাবার দ্বিতীয় সন্তান। আদর আর অর্থকষ্ট কিছুই বাবা তাকে কখনোই বুঝতে দেয় নি। ধনের অহংকার ধন থাকলে অনেকেই করে। কিন্তু অর্ণবের মধ্যে তা কখনো দেখা যায় নি। পান্তরে রাহীর পিতার ক্ষুদ্র একটি ব্যবসার দ্বারা সংসার চলতো। পিতার সামান্য আয়ে তার পড়ালেখার খরচ, অসুস্থ মাতার চিকিৎসা কোনমত হলেও চলতো। কিন্তু অবৈধ ব্যবসা উচ্ছেদের নামে তাদের বৈধ দোকানটিও ভিটেয় পরিণত হয়েছে। মতার অপব্যবহার বলে কথা। তাই তো দলীয় শক্তির ব্যবসা ঘর পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হলেও রাহীদের দোকানঘর এখনো ওঠানো সম্ভব হয় নি। রাহীর বাবা এখন হতাশার কাফনে জড়ানো একটি জীবন্ত লাশ।
সময়টা বেশি ভালো যাচ্ছে না কাসেম সাহেবের। কেন যেন তার বারবার করে মনে পড়ছে স্ত্রী রহিমার কথা। পছন্দ করে বিয়ে করেছিল তারা আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। কত মধুর সংসার ছিল তাদের। প্রেমের সার্থকতা নাকি ব্যর্থতায়? কিন্তু কাসেম সাহেব তা স্বীকার করেন না। বিবাহিত জীবনটা হাসি-আনন্দে মাতিয়ে রাখত সে। সুন্দর বউকে রেখে যখন কর্মস্থলে যেত তখন অন্তত কয়েক মিনিট তার দিকে তাকিয়ে থাকত। রহিমা লজ্জায় বলে উঠত- তোমায় নিয়ে আর পারি না। তারপর ৩ বিন্দু হাসতে হাসতে পিছনে ফেরা আর পথ চলা। রহিমাও যতদূর চোখ যায় ততদূর ………….।
সে হাসি কোথায় রহিমার? এতদিন হয়ে গেল, মেয়েটার খোঁজও নিল না। একবার তো স্বপ্নেও আসতে পারে। এই সংসার, বাড়িঘর, মেয়েটাকে আমি কার হাতে দিয়ে দিব? মৃত্যুর কথা ভেবে সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে আসে তার কাছে। চোখ অশ্রুসজল হয়ে আসে। অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে, রহিমা তোমার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাই। তোমার স্মৃতির সংসারে বিরহ যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারি না। আমিও তোমার কাছে যাব রহিমা। হঠাৎ পৃথিবী এসে বাবার চোখে অশ্রু দেখে আর ঠিক থাকতে পারল না। বলল, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ? আমি কি তোমাকে কোন কষ্ট দিয়েছি? বল, বাবা কেন এমন করে একাকী কাঁদছ? বাবা বলল, ‘না রে মা, আজ তোর মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। জানিস, তোর মা বড় স্বার্থপর। আমার সাথে না হয় অভিমান করেছে। তবে তোর মতো মেয়েকে রেখে সে কেমন করে থাকে বল তো?’
কাসেম সাহেব পৃথিবীকে বলল, মা তোকে একটি কথা বলব, শুনবি? পৃথিবী বলল, ‘বাবা, আমি কি কখনো তোমার কথার অবাধ্য হয়েছি।’ কাসেম সাহেব- তোকে আমি বিয়ে দিতে চাই মা। শরীরটা আমার ভালো নয়। মাঝে মধ্যে কেন যেন অনেক কথায় চিন্তা হয়। যাক সেসব কথা। ভালো বর দেখেছি তাও নয়। তবে তোর যদি কোন পছন্দের মানুষ থাকে, আমি না বলব না। পৃথিবী বলল, বাবা ওসব থাক। চল খাবে।
পিতার কথায় পৃথিবীর টনক নড়ল না তা নয়। চিন্তা করল, পিতাদের মানসিকতা এমন উদার হয়, এই বুঝি তার প্রমাণ। কোন এক অপরিচিত ছেলের কাছে যেতে হয় একজন মেয়ের। চেনা নেই, জানা নেই অথচ তারই কাছে সপে দিতে হয় জীবনের সবকিছু। নিজের চাওয়া, নিজের পাওয়া, নিজের হাসি, নিজের কান্না সবই তার স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ির উপর নির্ভরশীল। আচ্ছা, তিলে তিলে যে স্বামীটিকে মেয়েরা অন্তরে ধারণ করে সে স্বামী যদি তার অন্তরের দেবতার সাথে না মিলে যায় তবেই কি সংসারে অনিষ্ট ঘটে? হয় তো তাই। পৃথিবীর বুকের ভিতর দুর্নীবিত ঝড় হয়ে ইচ্ছের হলুদ পাখিটা যেন কান্ত হয়ে পড়েছে। স্থির করল রাহী অথবা অর্ণব যে কোন একজনকে বিয়ে করব।
অর্ণব ধনী বাবার সন্তান। টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে তার। সম্মান, বৈভব সবই যখন আছে তখন আর সমস্যা কি? অর্ণব ছেলে হিসেবেও মন্দ নয়। যতদিন একসাথে চলেছি একটি দিনের জন্যও তার মধ্যে কোন হীনতা দেখিনি। বড় লোকের সন্তানের এমন আচরণ এ তো দুর্লভ।
রাহী দরিদ্রতার কষাঘাতে মানুষ হলেও তার নম্রতা, মেধা অনেকটাই অলৌকিক। ঈদ, পূজা, মহরম, নববর্ষ, পুণ্যাহ আনন্দের সমারোহ বিদায় নিলেও রাহী যেন সে আনন্দের স্পর্শও পায় না। রাহী একদিন অনেক বড় হবে। দরিদ্র বাবার অভাব মোচন করবে। দণিার জোরে একটি সুন্দর বউ পাবে। আর অল্পে তুষ্ট স্ত্রীকে নিয়ে হয়তো একদিন সুন্দর একটি শান্তির নীড় গড়বে।
সেদিন কলেজ ক্যাম্পাসে বসে একাই উদাস অন্তরীে তাকিয়ে আছে পৃথিবী। মনে মনে ভাবছে কাকে বিয়ে করব? অর্ণব মন্দ হয় না, রাহী আরো ভালো হয়। তবে কাকে…………….?
অভাব যখন দরজা দিয়ে আসে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। অর্থাৎ ভালোবাসার সংসারে অভাব থাকতে পারে না। এবার সিদ্ধান্ত নিল অর্ণবকেই বিয়ে করব।
ঘটা করে চলছে বিয়ের আয়োজন। মায়ের শোকে বাবা এক সময় বিহ্বল হয়ে পড়লেও আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে তা উপশম হলো। খুব সুন্দর সাজে সেজেছে অর্ণব। বন্ধুরা অনেকেই এসেছে। পর্দার ফাঁকা দিয়ে বিয়ের আসনে অর্ণবকে দেখা যাচ্ছে। যেন কোকিলের গান, বাগানের ফুল, নদীর কুল কুল ধ্বনি আর প্রকৃতির অপরূপ শ্যামলতা সবই তার সৌন্দর্য বিলিয়ে দিচ্ছে বিয়ের আসরে। বাবা উপস্থিত হল মেয়ের কাছে। অশ্রুসজল বিদায়। এমন বিদায়ে পৃথিবীর এমন একটি হৃদয়হীন মানুষও নেই যে কাঁদবে না। রাজা-রাণী অথবা স্বর্গের দেবতা আর দেবীর মতোই লাগছে ওদের। যেন মণিকাঞ্চন যোগ। সানাইয়ের রৌদ্রে এক সময় নতুন ঠিকানায় পৌঁছে গেল পৃথিবী। আগে থেকে জানা হলেও শ্বশুর বাড়িতে এই প্রথম পৃথিবী।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলেন কাসেম সাহেব। ওযু করে নামায পড়লেন। মেয়ের শোবার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছেন। বলবেন, পৃথিবী মামুনি, তুই ওঠ। চা করবি না? হঠাৎ তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। মামুনি তো আর আমার সীমান্তে নেই। তার হাতের সুন্দর চায়ের স্পর্শ আমার ণকালের পরিচিত আপনজনের হাতে শোভা পাবে। ফিরে এলো দেিণর জানালার কাছে। বাতায়নের পর্দা উঠিয়ে দেখলেন, জীর্ণ ইট পাথরের চার দেয়ালে দুর্বা জড়ানো মাটির নিচে শুয়ে আছে রহিমা। অশ্রুতে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। উচ্চারণ করতে লাগল, রহিমা তোমার মেয়ে হয়তো ধারে পাওয়া পিতা-মাতা নিয়ে সুখেই থাকবে। কিন্তু আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না রহিমা। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু তোমার স্মৃতি। কয়েকদিন ভুলে ছিলাম তোমার রেখে যাওয়া অন্তরীকে নিয়ে। কিন্তু এখন চারপাশে যে শুধু খাঁ খাঁ করছে। তুমি কেমন আছ রহিমা। বড় অভিমানী তুমি, অদৃশ্যে বসে নিশ্চুপ। শুধু দেখে চলেছ আমার হাহাকার লীলা।
হাতের কাছে ফোনটি বেজে উঠল। পৃথিবী বলল, বাবা, তুমি কি নাস্তা সেরেছ? সেজ বুয়া এখনো আসে নি? জান বাবা, এ বাড়ির মানুষেরা কত ভালো- তোমার জামাই আজ বলেছে, ইহধামে আজ আমার বলে কিছু রইল না। সবকিছু তোমার। তুমি কিভাবে বিলাবে, কিভাবে চালাবে আমি তার কিছুই জানি না। বাবা মানুষ কতটা ভালো হলে এমনটা বলতে পার? বাবা সহাস্যে বলল, তুই সুখী হবি মা, তুই যে আমার লক্ষ্মী মেয়ে। বাবা বলল, তুই কিছু খেয়েছিস মা? পৃথিবী বলল, ওসব ভেবো না বাবা। কুঁড়ি জনের খাবার সম্মুখে থাকে। তাও আবার বলে, আমি নাকি তৃণভোজী।
অর্ণব নতুন বউয়ের নামে বাড়ির সম্মুখে নারিকেল ঘেরা বৃহৎ পুকুরটির নাম দিয়েছে ‘পৃথিবী সরোবর’। নামটি যে আদরের তা আর বলার অপো রাখে না। বাড়ির চারিদিকে যতদূর চোখ যায় আম, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠালে ঘেরা যেন বৃহৎ নিকুঞ্জ। মাঝে মাঝে যমুনার ঘাটে অথবা নির্জন বালুচরে বেড়াতে যায় স্বস্ত্রীক। সূর্যাস্ত দেখতে পৃথিবীর খুব ভালো লাগে। সমস্ত দিনের শেষে পাখিরা যখন নীড়ে ফেরে তখন সারিগাঁথা পাখির ঝাঁক, সন্ধ্যার নির্জনতা, সদ্য সূর্য হারানো ধরণী সবকিছু যেন আবেগ আপ্লুত হয়ে ধরা দেয় পৃথিবীর কাছে। সন্ধ্যার উন্মেষের পর আবার দুজনে ফিরে আসে ণিকালয়ে।
দয়াল বাবা নতুন আস্তানা গেরেছে মাজার সংলগ্ন মহাস্থান গড়ে। হতাশায় তার নিকট সমাধান মেলে এ কথা অনেক পুরানো। অবশেষে রাহী দয়াল বাবার আস্তানায় গিয়ে বাবাকে বলল, বাবা তুমি না বলেছিলে প্রেম যদি পবিত্র হয় তার মিলন ঠেকানো সহজ নয়। বাবা আমি তো সবকিছু দিয়েই পৃথিবীকে ভালোবেসেছি। তবে কেন না পাওয়ার হতাশা আমাকে এমন করে ঘিরে ফেলেছে। জান পীর বাবা, যেদিকে তাকাই সেদিকে শুধু পৃথিবীর ছায়া। আহার, নিদ্রা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমি আজ পথান্তরে। কেন সবকিছু দিয়ে তার স্পর্শ পেলাম না। তুমি পৃথিবীকে আমার কাছে এনে দাও বাবা। রাহী এবার চোখ বন্ধ করে মাজারের দিকে তাকিয়ে বির বির করে বলে উঠল, পৃথিবী তুমি আমার কাছে এসো। তোমাকে না পেলে অর্ণব তো মরবে না কিন্তু আমি যে মরে যাচ্ছি। দু ফোটা অশ্রু কপোল বেয়ে কায়ার সাথে মিশে যাচ্ছে। রাহী একবার মোছারও প্রয়োজনবোধ করল না।
পীর বাবা রাহীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলল, রাহী কানে কানে শোন। তুমি কি পৃথিবীকে তোমার কাছে একদিনের জন্য চাও, নাকি এক সপ্তাহের জন্য। রাহী খপ করে বাবার হাত ধরে বলল, আমি পৃথিবীকে হাজার বছর, ল বছর। পীর বাবা বলল, তাহলে তোমাকে যে একটু অপো করতে হয়। এতণে রাহীর চোখে মুখে স্বস্তির আভা ফুটে উঠেছে। বলল, বাবা আমি কিন্তু বেশি সময় অপো করতে পারব না। পীর বাবা বলল, স্রষ্টা ধৈর্যশীলদের পক্ষে।
গভীর এক বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে রাহী। অপো করছে প্রাপ্তির। কবে তার প্রাপ্তির ঝুড়িটা পূর্ণ হবে কে জানে? মিনিট যায়, ঘণ্টা যায়, ণ যায়, যায় মাসের পর মাস। সেদিন কোন মতেই ঘুম আসে না রাহীর। রাত্রি-দুপুরে রাস্তার পাশে বসে থাকে। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তারকারাজি। তিনটি তারার সারি আবার কখনো একগুচ্ছ তারকার মিল দেখে মন হাসিতে বলে, ওরা হয়তো গল্প করছে। একটা উজ্জ্বল তারার জ্যোতিতে ম্লান হয়েছে অন্য তারকাগুলো। আর তারই দিকে তাকিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলছে, বল তো আর কতদিন অন্তরীে থাকবে। শোন আমি কষ্ট পাই নি। আমি যে তোমাকে অনন্তকালের জন্য চাই। দেখ, তুমি যেভাবে চাইবে আমি তখন সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নেব। আর বেশি দেরী করো না। তোমার জন্য আমি কত কি সাজিয়ে রেখেছি দেখবে না? পাশে একটি কুকুর শিয়ালের মত দ্রুত দৌড় দিল। রাতজাগা চকরি মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটে রাত গভীরের বার্তা শুনায়। দূরে একটি লাইট পোস্টের দিকে তাকিয়ে থাকে ণিক। রাত্রি গভীর ধরণীর সবাই নিদ্রায় নিমগ্ন। ঘুম নেই শুধু এই একটি প্রাণীর।
পূর্ণিমার চাঁদ বিলিয়ে দিচ্ছে তার আলোর ফোয়ারা। গা এলিয়ে ইজি চেয়ারে ছাদে বসেছে পৃথিবী। মারমাদের গান শুনতে ওর খুব ভালো লাগে। মোবাইলে সে গানগুলোই শুনছে সে। অর্ণবের ফিরতে একটু রাত হবে। নতুন একটি কোম্পানির শেয়ারের চুক্তি চলছে ওদের তাই ব্যস্ততা। নিচের অন্ধকার লিচু বাগানে জোনাকিরা আলো বিলাতে মাতোয়ারা। অদূরে একটি জোনাকিকে অন্য দুইটি জোনাকি তাড়া করছে। অন্ধকার নিশিথে তিনটি জোনাকি আর তাদের উচ্ছ্বল আনন্দ আজ রাহীর কথা মনে করিয়ে দিল পৃথিবীকে।
কত ভাল বন্ধু আমার রাহী। এক সাথে থেকেছি স্কুলে কলেজে আবার খেলার মাঠে। কি নম্র ছেলেটি। একদিন ও হয়ত ভেবেছিল আমি ওকেই নিয়ে সংসার করব। কিন্তু বিধি বাম জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এগুলোতে নাকি বিধাতার হাত।
সেদিন রাহীকে দূরে থেকে দেখেছিলাম নদীর ঘাটে একা একা বসেছিল। ভাবলাম কথা বলব কিন্তু তা আর হল কই। আচ্ছা ও কি ভাবছিল? কেন জনকোলাহল বাদ দিয়ে একাকী এমন নির্জনতা। হয়তো আমাকেই চিন্তা করছিল সে। বিয়ের দিনে শুনেছি ওর উন্মাদনার কথা। আচ্ছা গরীব বলেই কি ওকে আমার ছেড়ে আসা উচিত হয়েছিল? আমি নিশ্চয়ই ঠিক করি নি। কারো মনে আঘাত দিয়ে কেউ কি কখনো সুখী হতে পারে?
অর্ণব এসেছে। পৃথিবীর মন ভার বুঝতে পেরে অর্ণব বলল, তোমার কি শরীর খারাপ? পৃথিবী মাথা নেড়ে বলল, না। প্রতিদিনের তুলনায় আজ অর্ণব আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত্রীর তৃতীয় ভাগে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে অর্ণব দেখল পৃথিবী বিছানায় নেই। চমকে উঠল সে। কোথায় যেতে পারে? বাহিরে? না, ও তো যথেষ্ট ভয় পায়। বিয়ের পর থেকে রাতে একা উঠে বসে নি কখনো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল। অন্ধকার রাত, আকাশ ভরা তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ছাদের ঠিক পূর্ব কোণায় সিঁড়ি ঘরের সাথে মাথার পশ্চাৎদেশ লাগিয়ে সম্মুখে তাকিয়ে আছে পৃথিবী। পিছন থেকে ডাকল অর্ণব। চমকে উঠে পৃথিবী বলল, অর্ণব ঘুম আসে না। অনেক চেষ্টা করছি। তাই ছাদে এলাম। অর্ণব কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, বলতো তোমার কি হয়েছে? পৃথিবী কোন উত্তর করল না। আবার বলল, দেখ পৃথিবী মনে কি আছে আমি জানি না। তবে তোমার এমন পরিবর্তন আমাকে সন্দেহের সাগরে ফেলে দিয়েছে। পৃথিবী বলল, অর্ণব তুমি আমাকে ভালোবাসার কোন ত্রুটি করো নি। জানি তুমি আমাকে সব দিয়েছ। কিন্তু এত আদর এত সুখ এত পাওয়া তবুও কেন এমন হয় বলতে পার?
পরদিন পৃথিবীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। অফিস থেকে ফিরে বাড়ির লোকজনের কাছে শুধু জানতে পেরেছে পৃথিবীর বাবা অসুস্থ। অর্ণব সেখানেও সন্ধান করল কিন্তু পাওয়া গেল না।
হাতিরপুল প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার পাশে ছোট একটি খাল পার হয়ে রাহীদের বাড়ি। তন্ন তন্ন খুঁজেছে সে। কোথাও না পেয়ে অবশেষে লক্ষ্মী নদীর পশ্চিম পাড়ে বট বৃরে নীচে পৌছে গেল পৃথিবী। রূপালী দিদির তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর এই অনুসন্ধান। নিজে নিঃশেষ হয়ে যাবে তবুও রাহীর অকাল মৃত্যু সে সহ্য করতে পারবে না।
লক্ষ্মী নদীর পাড়ে বট ঘাটের পাশে একটি বৃন্দা গাছের আড়ালে বসে পানিতে ইঁদুরের মাটি ছুড়ছে রাহী। স্বচ্ছ পানিতে ঢিলের আঘাতে ক্ষুদ্র ঢেউগুলি নদীর দু’পাশে যাওয়ার আগেই আবার ঢিল ছুঁড়ছে। নীল আকাশ জলের নিচে লুকোচুরি খেলছে। অপোর প্রহর তার কখন ফুরাবে কে জানে? হঠাৎ পিছনে ফিরেই পৃথিবীর মুখের ওপর নজর পড়ল রাহীর। বিশ্বাস করতে পারছে না একেবারে। ঠাঁই থেকে দাঁড়িয়ে দু’হাত প্রশস্ত করে রাহী বলল, হে আল্লাহ! তুমি এত দয়ালু। দয়াল পীরের দরগা এত সত্য! I am very very happy. God bless you with his love that makes everyday a joy to live.
পৃথিবী রাহীর ঠিক মুখের কাছে এসে বলল, রাহী আমি তোমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমাকে মা করবে না? রাহী- না। না পৃথিবী তোমার মা চাইতে হবে না। আমার শত আকাক্সার আয়োজন তো তুমিই। পৃথিবী- তুমি এখন আমাকে গ্রহণ কর রাহী। ভুল শোধরাতে আমি অর্ণবকে ত্যাগ করে তোমার কাছে চলে এসেছি। রাহী তার মুখের দিকে তাকিয়ে দু’হাতে পৃথিবীর চিবুক স্পর্শ করে বলল, পৃথিবী অর্ণব তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না? শোন, ও খুব বোকা। তোমাকে মাত্র ণকালের জন্য গ্রহণ করেছে। আর আমি তোমাকে নিব জনম জনম কাল অনন্ত কাল।
গোধূলীর প্রান্ত লগ্ন। বৃদ্ধ সূর্য এখনি নিভে যাবে। রাতের তারকাগুলো একটু আগেই নিজের প্রকাশ ঘোষণা করছে নীলাকাশে। পৃথিবী কিছুই বুঝতে পারল না রাহীর কথা। বলল, রাহী চল তোমার ঘরে যাই। আমরা দ্বিতীয় বিয়ে করব। আমি তোমার ঋণ শোধ করতে স্বর্গের সুখ ছেড়ে এসেছি। অর্ণব অনেক ভালো ছেলে। তবুও তুমি যে আরো ভালো। রাহী বলল, অসম্ভব। এ হতে পারে না। তুমি আমাকে ঠকাতে পার না। তুমি অর্ণবের কাছে যাও। ও আমার ভালো বন্ধু। আর মাত্র ক’টা দিন দুনিয়ার মায়া। তারপর মরণের পর মহাকালে হবে তোমার আমার সজ্জিত বাসর। সেখানে অবাধ বিচরণ করব আমি আর তুমি। তুমি ফিরে যাও পৃথিবী। পৃথিবী বলল, তুমি যদি আমায় এখন গ্রহণ না কর মৃত্যু ছাড়া আমার দ্বিতীয় পথ নেই। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখান থেকে আসা যায় কিন্তু ইচ্ছা করলেই ফিরে যাওয়া যায় না। কিন্তু তোমাকে ফিরে যেতেই হবে। তা না হলে আর মাত্র ক’টা দিনের জন্য আমি তোমাকে নেব না। অর্ণব কষ্ট পাবে। আমি ঠকে যাব। আমি আর ঠকতে চাই না পৃথিবী। তোমাকে যে আমি অনন্তকাল ধরে চোখের সম্মুখে রাখতে চাই।
অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কিছুণ পরেই হয়তো মানুষের আনাগোনাও কমে যাবে। নিস্তব্ধ হবে ধরণীর সকল কলরব। কোন দিকে যাব? অর্ণব না রাহী। ও খোদা তুমি আমায় কোন পরীায় ফেললে? হাটতে হাটতেই রাত্রী কেটে গেল। নীলিমার আলো আর দেখতে ইচ্ছে করে না। দুই কুলই শেষ করেছি। এখন একটি পথ আমার খোলা। আমি সেই পথেই যাবো। কিন্তু বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। চোখের পানি একবার মুছে নিল। চু ভরে বাবাকে দেখব। তারপর বলব, বাবা খুব সুখে আছি। যেমন করেই হোক বাবার মুখ ভরা হাসি দেখে বিদায় নেব। ঐ যে মায়ের নিজ হাতে গড়া লিচু বাগান, নারিকেল গাছ, খিলানের পুকুর ঘাট উঁচু হয়ে আছে। আচ্ছা, ওখানে এত লোক কেন? একটু দ্রুতই পা তুলছে পৃথিবী। বাড়ির ঠিক নিকটে পৌঁছতেই যা অনুমান করল তা আর মিথ্যা নয়। সারা রাত্রি মেয়ের পথ চেয়ে থেকে বাবা আমার একটু আগেই মায়ের কাছে পৌঁছে গেছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। স্বজনরা অনেকেই তাকে সান্ত¡না দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করল। জ্ঞান ফিরে যখন সে বাবার মুখখানি দেখতে চাইল ততণে বাবা দাফন কার্য সমাপ্ত হল।