কূটনীতি


হোসনে আরা মণি
শেষকালে স্বাধীন সেই বহুকাক্সিক্ষত শব্দটি উচ্চারণ করল। এটা যে সে কোন দিন সত্যিই বলবে তা রিয়ানা যেমন বিশ্বাস করেনি তেমনি স্বাধীনও বুঝি কোন কালে ভাবেনি। স্বাধীনের ভাবভঙ্গিতে রিয়ানার মনে হত যে এ অসম্ভব, স্বাধীন কখনোই ঐ শব্দটা উচ্চারণ করবে না, এ তার স্বভাবেই নেই। অথচ যদি করত! আহা! রিয়ানার সব কষ্ট, রাগ, ক্ষোভ গলে জল হয়ে যেত। তখন স্বাধীনের জীবনে নিজেকে জড়িয়ে রাখা হয়ত কিছুটা সহনীয় হয়ে উঠত। স্বাধীন যখন রিয়ানার কাছে তার অপারগতা স্বীকার করে ‘সরি’ বলে ক্ষমা চাইল তখনো যেন রিয়ানার বিশ্বাস হয়নি যে এটা সত্যিই ঘটছে। তারপর ক্ষমাপ্রার্থনার সঙ্গে স্বাধীন যখন ঐ অদ্ভূত লেজুড়টি জুড়ে দিল তখন তো রিয়ানার বিস্ময় এতটাই উধ্র্মুখী যে সে তা ছাপিয়ে কিছুতেই তার নাটাইছেঁড়া বিশ্বাসঘুড়ির নাগাল পায় না। রিয়ানার মনে হয় সে যেন স্বাধীনের মুখ থেকে এমনই এক রূপকথার ইঙ্গিত শুনছে যা জগতে কোনকালে ঘটেনি, ঘটবেও না।
সময় গড়াতে থাকে, গড়িয়ে যায়।  স্বাধীনের কথাগুলো রিয়ানার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকতে থাকে। তার কাছে মনে হতে থাকে যে হ্যা, সে চাইলেই পারে। নিজের একান্ত সুখের আনজাম সে যেভাবে খুশি করতে পারে। শুধু স্বাধীনের শর্তটা মেনে চললেই হয়। কিন্তু কিভাবে? কোন উপচারে সে সাজিয়ে নেবে তার কাক্সিক্ষত সুখাঞ্জলি? স্বাধীনের সংসারে টিকে থেকে, আদিবের লক্ষ্মী মা হয়ে বেঁচে থেকে কাকে সে স্বাগতম জানাবে তার একান্ত বাসনার পূজারি পদে? উমেদারের অভাব নেই। কাউকে গ্রিন সিগন্যাল দিলেই হয়। কিন্তু কাকে?
‘জেনে ফেললে কী যে হবে! এই বুঝি কী ভাবল!’- ঘরানার ভাবনাগুলো আর মগজের কোষগুলোকে ভারাক্রান্ত বিষাক্ত করে তুলবে না। ঘরে ফেরার তাড়ায় উপভোগ্য মুহূর্তগুলো স্নায়ুচাপের উৎকটতায় স্নায়ুবৈকল্য ঘটাবে না। তবু মনে ভয়, কোথায় যেন অস্বস্তির চোরকাঁটা- এত ভালমানুষি! এই অবিসংবাদিত উদারতার মধ্যে কোন দুরভিসন্ধি লুকিয়ে নেই তো? কোন প্রতিশোধ প্রচেষ্টা? হাজার হোক পুরুষ- দাঁতে বিষ না থাকলেও সাপ তো বটে!
স্বামী অথচ গান্ধীজির আদর্শ! স্ত্রীর সুখ-সাধ মেটাতে রশি ঢিলা করা! উহু! ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তা কেন? এতকাল পরে হলেও লোকটা হয়ত জীবনের বাস্তবতা বুঝেছে। বুঝেছে দেহ-মনের দাবী। বুঝবে নাই বা কেন? ও তো সেই লোকটাকে ভাল করে জানে- বিশাল ব্যবসায়ী- দুইটা ব্যাংক, তিনটা ইন্স্যুরেন্স ও লিজিং কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডার-ডিরেক্টর রিয়াজ উদ্দিন মালিক। পৈতৃক গম-আটার ব্যবসাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মাত্র ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সে যিনি ঐ স্তরে নিতে পারেন তার বুদ্ধি-শুদ্ধি সম্পর্কে সবাই উঁচু ধারণাই পোষণ করে। অথচ তিনি করলেন কী- একটা ‘হাই প্রোফাইল’ রূপোপজীবিনীকে বিয়ে করে নাকি বললেন, তুমি যেমন খুশি জীবন-যাপন করতে পার, শুধু দুটো শর্ত মেনে চোলো- বাইরে কোথাও যেতে হলে অবশ্যই বাড়ির গাড়িতে করে যেও আর কখনো কনসিভ কোরো না। কিন্তু একজন নাপুরুষ লোকের ওরকম একটা টগবগে যুবতীকে বিয়ে করার কী দরকার? হ্যা, সে পক্ষেও যুক্তি আছে। রিয়াজ উদ্দিন মালিককে মাসে কয়েক ডজন পার্টিতে এটেন্ড করতে হয়। সেখানে তাকে প্রায়ই একটা নিষ্ঠুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়- আর কত দিন? মেঘে মেঘে বেলা তো কম হল না…..ইত্যাদি। এমন প্রশ্নের মুখে একটু শুকনো হাসি ছাড়া রিয়াজ উদ্দিনের দেয়ার মত কিছু থাকে না। রিয়াজ উদ্দিনের ধারণা যে কিছু লোক তার সম্পর্কে জেনে-শুনেও নির্মম তামাশার আনন্দ পেতে ঐ প্রশ্নগুলো করে। আর যারা সত্যিই কিছু জানে না তাদের কেউ যখন খাঁটি আন্তরিকতা থেকে অমন প্রশ্ন করে তখন রিয়াজ উদ্দিনের চোখে জল আসার উপক্রম হয়। রিয়াজ উদ্দিন জানেন যে এদেশের মানুষে মানুষে অর্থ-বিত্ত এমন কি শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যাপক পার্থক্য গড়ে উঠেছে কিন্তু ইতরবিশেষ ঘটেনি তাদের মনোবৃত্তিতে। শ্রেণী নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষই তাদের ভেতরে একটা অসংস্কৃত-অকর্ষিত আদিম মনোভাব লালন করছে। এদেরই কারোর হাল-ফ্যাশনের পোশাক আর ফটফটানো বাংলিশ বচন ফুঁড়ে ভেতরকার অমার্জিত-স্থূল প্রবৃত্তির প্রকাশ যখন-তখন ঘটে যায়। রিয়াজ উদ্দিন ঐ প্রবৃত্তিকে ঘৃণা করলেও প্রবৃত্তিঅলা/অলীদের সমঝে চলেন। এরা তারই কমিউনিটিভুক্ত মানুষ। এদেরকে এড়িয়ে চলার সাধ্যি তার কোথায়? অবশেষে সবার থোতা মুখ একদিন সত্যিই ভোঁতা হয় যখন রিয়াজ উদ্দিন তার আহুত এক জাঁকজমকপূর্ণ পার্টিতে বাহুতে জড়ানো এক লতানো রূপসীকে নিয়ে হলঘরে প্রবেশ করেন।
সে পার্টিতে স্বাধীন-রিয়ানাও ছিল। আর সবার মতই চক্ষু চড়কগাছ হওয়া স্বাধীন রিয়ানার কানে কানে বলে, মামায় এ কী কাম করল!
রিয়ানা চোখ কপালে তুলে বলে, বসকে মামা বলছ! তোমার সাহস তো কম না!
স্বাধীন একটুখানি ইতিউতি তাকিয়ে সাবধানতার সাথে ফিসফিসিয়ে বলে, আরে, মামাই তো। খালি কি আমার মামা! উনি আমাদের জাতীয় মামা, আন্তর্জাতিকও বলতে পার। মামা না থাকলে আমরা কোথায় ভেসে যেতাম!
তা বটে। ঐ মামার জোরেই স্বাধীন এখন জে কে ইন্স্যুরেন্সের ডিজিএম। মামা শুধু স্বাধীনকেই নয়, তাদের গ্রামের আরো জনাবিশেক ছেলেকে ব্যাংক-বিমা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার পাশাপাশি ডজন ডজন নারী-পুরুষকে রপ্তানীরও ব্যবস্থা করেছেন। মামার রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে কখনো কারো প্রতারিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
তো এই রিয়াজ উদ্দিন মালিকের কর্মকান্ডকে গভীর সহানুভূতির সাথে বিশ্লেষণ করেই কি স্বাধীনের বোধোদয় ঘটল? রিয়ানা যে নান কিংবা তাপসী নয়, বরং রক্ত-মাংস-হরমোন সম্বলিত সাধারণ মানবী তা কি সে এতদিনে উপলব্ধি করল? যাক, এখন কথা হচ্ছে এই হঠাৎ পাওয়া গুপ্ত স্বাধীনতা সে কিভাবে কাজে লাগায়।
সায়ন ইসলাম। আরিয়ান সানি। দীপ্ত প্রত্যয়। মোছাদ্দেক আলী। তরিকুল হাসান।- কাকে? কে হতে পারে রিয়ানার কোর্টশিপ মেট?
সায়ন? লম্বা-চওড়া-ফর্সা রাজপুত্র ঘরানার চেহারার সায়ন। লম্বা চুল মাথার পেছনে ঝুঁটি করা। টানা টানা চোখ দুটোতে কী যে গভীর মায়া! সেই সাথে দারুণ আকর্ষণীয় তার রাবীন্দ্রিক বাচনভঙ্গি আর মাধুর্যময় কণ্ঠে গীত আধুনিক গান। রক-ফোকও সায়নের কণ্ঠে দারুন যায়। কিন্তু রিয়ানা মূলতঃ তার কণ্ঠে আধুনিকটাই শুনতে চায় বেশি। তবে এত গুনী গায়ক কেন যে এখনো জাতীয় পর্যায়ে কল্কে পাচ্ছে না তা রিয়ানা ভেবে পায় না। সায়ন রিয়ানাকে বুঝায়- এটাই বাস্তবতা রিয়া, তুমি যতই ভাল গাও না কেন, কিছুতেই কিছু হবে না যদি না তুমি রাজধানীবাসী হচ্ছ এবং লাইন-ঘাটের ফর্মুলা বুঝছ। রিয়ানা বলে, তা তুমি রাজধানীতে যাচ্ছ নাই বা কেন? সায়ন হাসে। মফস্বল শহরের সুখ-আরাম ছেড়ে ঢাকায় ভেড়ার পালের গাদাগাদি দশার প্রতি তার নাকি তীব্র বিতৃষ্ণা। তাছাড়া এখানে তার বাড়ির ঘরে নিজস্ব স্টুডিও, সবরকম সুব্যবস্থা। গান লেখা, সুর করা আর বছরে-দু’বছরে একটা দুটো অ্যালবাম করার জন্য কেন হতে হবে ঢাকাবাসী? মুক্তবাজার অর্থনীতি আর প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে গোটা পৃথিবীটা তো একটাই ভিলেজ। তোমার যদি মেধা আর প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা থাকে তো তুমি পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বসে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে। তো সেই চেষ্টাই চলছে। সায়নের গান এখন লোকাল টিভি ও ইউটিউব চ্যানেল দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এতে যত না সায়নের নাম ছড়াচ্ছে তার চেয়ে বেশি উড়ছে টাকা। এ রকম একটা লোকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে….তাছাড়া সে যে রিয়ানার সাথে জড়াবে তারই বা কী নিশ্চয়তা? খালাত ভাইয়ের খুব কাছের বন্ধু সায়ন, সায়ন ভাই। যে খালাত ভাই এক সময় রিয়ানার জন্য দেওয়ানা ছিল এবং হয়ত আজো কিঞ্চিৎ আছে। শিপন ভাই যে এখনো রিয়ানার জন্য গোপন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে এতে রিয়ানার কোনই সন্দেহ নেই। তার এবং এ রকম আরো কিছু পুরুষের দীর্ঘশ্বাসের ‘অভিশাপে’ই না রিয়ানার আজ এমন দশা! কিন্তু সায়ন তো কোন দিন রিয়ানাকে ও চোখে দেখেছে বলে রিয়ানার মনে পড়ে না। সে তো বরং শিপনের হয়ে ঘটকালির চেষ্টা করতে গিয়ে কতবার কত কটূ কথা শুনেছে!
আরিয়ান সানি। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ধারাল চেহারার পুরুষ। পেশায় ব্যবসায়ী। আর নেশাটা বুঝি নারী শিকার? রিয়ানার তাই ধারণা। নইলে একদিন এক দূরপাল্লার গাড়িতে পরিচয়ের ফল কি এই হয় যে সে রিয়ানার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে রাজধানী থেকে এসে হানা দেয় এই ৩০০ কিমি দূরের মফস্বল শহরে? বরাবরই সানি নিজেকে অবিবাহিত বলে পরিচয় দিয়ে এসেছে কিন্তু রিয়ানা তা বিশ্বাস করে না। তার যুক্তি এই যে একজন স্বচ্ছল সক্ষম ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী ব্যবসায়ী যিনি বছরে নাকি চার-পাঁচটি দেশ ভ্রমনই করেন তিনি কী কারণে বিয়ের মত একটা আটপৌরে কাজকে ফেলে রাখেন? তাছাড়া লোকটার চেহারায় এমন একটা উৎফুল্ল প্রত্যয়ী ভাব সবসময় খেলা করে যাতে করে তাকে সুখী গৃহস্থ বলেই মনে হয়। এমন একটা অস্বচ্ছ চরিত্রের লোকের সাথে জড়াতে রিয়ানার বড্ড ভয়। তাছাড়া লোকটার দাবী ঠিক, নাকি রিয়ানার ধারণা- তা যাচাইয়ের সুযোগই বা কই? ফোন কিংবা নেটে যোগাযোগের বাইরে সানির সাথে আর কোন যোগাযোগ রক্ষা বা তার ব্যাপারে কোন খোঁজ-খবর করা রিয়ানার সাধ্যাতীত না হলেও উৎসাহের একান্ত অভাব।
নামের মতই প্রত্যয়ী হাবভাব ও বচন-ভাষণ উঠতি কবি দীপ্ত প্রত্যয়ের। বেতের মত টানটান ছিপছিপে তরুণের দু’চোখ ভরা স্বপ্নের ঝিকিমিকি। রিয়ানাকে সে যে খুবই পছন্দ করে তার অজস্র নমুনা পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন কথা ও কাজে। তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘স্বপনে তুমি জাগরণে তুমি’ সে উৎসর্গ করেছে রিয়ানাকে। একটা ভাল কবিতা লিখলে তা রিয়ানাকে না শোনানো পর্যন্ত তার শান্তি নেই। রিয়ানাও যে একসময় কবিতা লিখত এবং বর্তমানে রিয়ানা একজন ভাল আবৃত্তিকার এটা জেনে সে যারপরনাই মুগ্ধ। কিন্তু তার এই মুগ্ধতা কি শুধুই রিয়ানাতে? তবে যে আরো কত রমনী যাদের অধিকাংশ রিয়ানার মতই বয়োজ্যেষ্ঠ এবং যারা প্রত্যয়কে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে আশঙ্কাজনক মাত্রায়- তাদের সাথে প্রত্যয়ের কেমন সম্পর্ক? রিয়ানার তো ধারণা এই যে প্রত্যয় এদেরই কারো কারো হাত তোলা হয়ে রাজধানীতে টিকে আছে। নইলে মফস্বল থেকে ঢাকাবাসী হওয়া বেকার কবি বাহ্যত কোন উপার্জনসূত্র না থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে খাই-খরচা না নিয়ে চলে কী করে? নাহ্, রিয়ানা এতটা নারীবাদী নয় কিংবা এত বেশি দায়েও পড়েনি যে শেষকালে তাকে একটা ‘রক্ষিত’ পুষতে হবে।
আর মোছাদ্দেক আলী? হায়! চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ লালসা ছাড়া ঐ হামবড়ার মাঝে যদি আর কিছু থাকত! রিয়ানার সাথে তার পরিচয় হয়েছিল এক আবৃত্তি সন্ধ্যায়। রিয়ানা সে অনুষ্ঠানে সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিল। অনুষ্ঠানের নাম ছিল আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব। আন্তর্জাতিকতা বলতে পশ্চিমবাংলার অখ্যাত দু’জন লিটলম্যাগীয় কবির আগমন সম্ভাবনা। তা শেষ পর্যন্ত তারা না এলেও উৎসবের নামে কোন হেরফের হয় না, আড়ম্বরেও কোন খামতি ঘটে না। শহরের ডিসি-এসপি-ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুরগণ সকলেই কবি। এবং তাদেরই কবিত্ব প্রকাশের ব্যাপক উদ্যমের মাঝে যেটুকু অবসর সে ফাঁক রিয়ানা ভালভাবেই পূরণ করছিল তার সুললিত কথামালা ও টুকরো আবৃত্তি দিয়ে। সেই অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে যেচে এসে পরিচয় করেছিল ম্যাজিস্ট্রেট মোছাদ্দেক আলী। এরপর মোছাদ্দেকেরই উদ্যোগে তাদের মাঝে আরো কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেসব ‘সিটিং’ কিংবা ‘ওয়াকিং’ থেকে রিয়ানা লোকটার সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। সাংঘাতিক বাচাল ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ মানুষ। সর্বদা জ্ঞানের বহর দেখাতে ব্যস্ত। সে জ্ঞান আবার পাঠ্যপুস্তকের গন্ডীবদ্ধ। ক্যাডার সার্ভিসের গুটিকতক ক্যাডারের বাইরে যেকোন পেশার মানুষকে ছোট করে দেখার প্রবনতা তার মজ্জাগত। এমন চরিত্রের মানুষকে রিয়ানা কয় দিন সহ্য করতে পারে?
সাংবাদিক তরিকুল হাসান। জেলা শহরে বসেও যিনি মহানগরীর প্রথম সারির এক সংবাদপত্রে ‘লিডিং পজিশন’ এ আছেন। হাসি-খুশি প্রাণবন্ত বিনম্র ব্যক্তিত্বের মানুষ। রিয়ানাকে যে কতটা পছন্দ করেন! শুধুই কি পছন্দ? শুধু পছন্দের মানুষের জন্য কি অতটা করা যায় যতটা করেন হাসান ভাই? রিয়ানার একটু মন খারাপ হলেও যেন তিনি তা টেলিপ্যাথীর মাধ্যমে বুঝতে পারেন। রিয়ানার মুখে এক টুকরো হাসি দেখলে যেন তিনি বর্তে যান। ষাটের কোটায় বয়সী এই মানুষটার প্রতি রিয়ানার কী মনোভাব?- ছিঃ! উনি পিতৃতুল্য একজন মানুষ…..
আর তবে কে কে আছে রিয়ানা? স্কুলজীবনের বন্ধূ দুবাই প্রবাসী সাজ্জাদ কাদির, ভার্সিটির সহপাঠী দীপন মাহমুদ, কলেজে একসময়ের সহকর্মী শফিউল আজম, ফেসবুক বন্ধু রিপন, দোদুল, অরিত্র, সৌমিক, নাকি প্রতিবেশি তাজুলুদ্দিন তরফদার? এদের মধ্যে কে বা কে কে তোমাকে টানে? রিয়ানা এবার একটা অতি দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে। তালিকাটা কতই না লম্বা। অথচ তার মনের মানুষ হওয়া দূরে থাক, দেহের দাবী মেটাবার মত মানুষেরও আজ কত অভাব! অথচ এদের অধিকাংশই রিয়ানার একটা সংকেতের অপেক্ষায় প্রায় ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে। রিয়ানা তা বোঝে কিন্তু সাড়া দিতে পারে না। এ কি তার মজ্জাগত সতীত্ববোধ যা পূর্বনারী পরম্পরায় তার রক্তে প্রবাহমান? তা কেন? নারী কি আজ তার মনের জিঞ্জির ঝেড়ে ফেলে নি? ফেসবুকে কিছু নারীর স্ট্যাটাস-কমেন্ট পড়লে তো মনে হয় যেন এরা দুর্মুখ পুরুষেরও এককাঠি বাড়া। মামুলি বিষয়ে কুৎসিত গালাগাল, হুমকি-ধামকি থেকে শুরু করে যেকোন জটিল বিষয়ে সুচিন্তিত যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ কিছুতেই তারা পিছপা নয়। তবে? হায়! এতকাল ধরে নিজেকে এত আধুনিক মনে করা রিয়ানা আজ তুলে দেয়া স্বাধীনতা হাতে পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারে না। ভয়, হ্যা, একটা দুরন্ত ভয় ও অবিশ্বাস তাকে পেয়ে বসে। অবিশ্বাস খোদ স্বাধীনের প্রতি- যে স্বাধীনতা সে ঘোষণা করল তা ভোগের স্বাধীনতা কি সত্যিই রিয়ানার আছে? প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে প্রমান যোগাড়ের অপেক্ষায় সে ওসব বলে নি তো? সত্যিই কি সে চুপচাপ সহ্য করবে রিয়ানার পরপুরুষ আসঙ্গ? তাছাড়া সেই এক রাতে কিছুক্ষণের তরে তিনি মুখ খুলে ছিলেন, ফের তো কুলুপ এঁটেছেন। কে জানে তার মনে এখন কী আছে! মন না মতি- কখন কতটা বদলায় তা কে বলতে পারে! শেষে ঘটনা ঘটার পর যদি তিনি গান্ধীবাদী নীতি ত্যাগ করে বসেন, তখন কী হবে? আদিবকে ছেড়ে, অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে এই শ্বাপদসঙ্কুল সমাজে দিন গুজরানের সাহস তো রিয়ানার নেই। আসলে কোন পরিবর্তনকে স্বাগতম জানানোর সাহসই বুঝি তার নেই। নইলে নিজের একান্ত সুখের জন্য একটুখানি ঝুঁকি নিতে কেন তার এত ভয়? কেন তার চোখে ভেসে ওঠে বিভিন্ন সময়ে অন্তর্জালে ঝড় তোলা সেই বিশেষ ভিডিওগুলো ….? ঐ মেয়েগুলোওতো কতই না বিশ্বাসে সঁপেছিল সব……কিংবা এতটুকুও অনাস্থার ভাবনা মাাথায় ঠাঁই না দিয়েই মত্ত হয়েছিল চরম উপভোগে। নাহ্! চরম মুহূর্তে পরম নিশ্চিন্তে কোন কাঙ্খিতের কাছেই রিয়ানা নিজেকে সঁপে দিতে পারবে না। অদৃশ্য ক্যামেরার কুটিল চোখের হুমকি তার মন থেকে সে খসাতে পারবে না। আর মনের একটা অংশকে আড় করে রেখে আরেকটা অংশ কী করে পারে উপভোগে মত্ত হতে? তাছাড়া পারস্পরিক পরম আত্মনিবেদন ছাড়া ওসব তো অর্থহীন। মানুষের দেহ তো আর যান্ত্রিক ধানকল নয়, মনও নয় কোন উইন্ডোজ সাপোর্ট সফটওয়্যার।
চোখমুখে গরম ভাপ, মাথায় নিদারুণ উত্তাপ। মধ্যরাতে শুন্য শয্যা ছেড়ে তপ্ত নারী প্রবেশ করে স্নানঘরে। কল খুলে মাথায় জল ঢালে কতক্ষণ। এ সময় সে কাঁদে। তার জীবনের সমস্ত কান্না তো সে কল খুলেই কেঁদেছে। কান্নাটা ধরে এলে তোয়ালে দিয়ে মাথা মোছে। দীঘল চুলে তোয়ালে প্যাচাতে প্যাচাতে এসে দাঁড়ায় ঘর লাগোয়া ঝুলবারান্দায়। পাশের ঘরে স্বাধীনের নাক ডাকার আওয়াজ এ ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েও শোনা যায়। উঁচু ভবনের ঝুলবারান্দায় গ্রীলের নিরাপত্তায় আটকে থাকা নারী সামনের একচিলতে আকাশে অগুনতি তারার সমাবেশ দেখে আর দেখে তার প্রেমপিয়াসীদের সমাহার। ওরা সবাই যেন তার দিকে চেয়ে হাসছে। প্রেমমাথা স্নিগ্ধ হাসি নয়, উৎকট ব্যঙ্গে মুখ ব্যাদান করা হাসি। হাসতে হাসতেই তাদের একেকজন একেক কটূ মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে। এরই মাঝে শিপন ভাইয়ের মুখটা বিশেষ ভাবে ফুটে আছে কারণ একমাত্র সেইই রিয়ানার দিকে চেয়ে হাসছে না। বড়ই দুঃখী দুঃখী মুখ করে কেমন অনিমেষ চেয়ে আছে দেখ। ব্যর্থ প্রণয়প্রার্থীদের উচ্চকিত হাসির উৎকটতা কমে আসে। তাদের মুখও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর দেখায়। সমস্ত আকাশ জুড়ে শুধু শিপন ভাইকেই দেখতে পাওয়া যায়। ম্লান হেসে শিপন ভাই বলেন, বুঝলি রি, আমি জানতাম একদিন তোর এমন দশাই হবে। জগতে যে বেশি পায় সে আসলে কিছুই পায় না রে। পাওয়াটা যত সহজ হয়, পাওয়ার আনন্দ ততই কমে আসে। তাই দেখিস না- মানুষ যত ভোগ করে ভোগলিপ্সা তার ততই বাড়ে? যা আছে তা নিয়ে সে খুশি নয়, সে খোঁজে আরো কিছু। তুই বড্ড বেশি পেয়েছিস রি, কিন্তু কিছুই নিতে শিখিসনি। তুই আর নিতেও পারবি না কারণ তোর মাঝে ঢুকে গেছে সর্পভয়। আর জানিস তো, সাপের ভয় অন্ধকারেই বেশি থাকে। আমরা যে এখন এক আঁধার সময়েই আছি রে রি।
রিয়ানা কিছু বলতে চায় কিন্তু তার গলাটা কেমন বুজে আসে। অশ্রু জমা চোখে সমস্ত আকাশটা কেমন ঝাপসা দেখায়। সে ঝাপসা আকাশে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় তার শিপন ভাই যে একসময় তার জন্য পকেট ভর্তি ঘুমের বড়ি নিয়ে ঘুমাত। ঘরের ভেতর থেকে ঘুমভাঙ্গা শিশুর ভীত কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। এক ছুটে রিয়ানা প্রবেশ করে মশারীর গহ্বরে। তুলতুলে নরম শিশুদেহকে বুকের উত্তাপে মিশিয়ে নিতে নিতে কখন যে তার সমস্ত ভাবালুতা আপাত দূর হয় তা সে জানতেও পারেনা। এটাও সে ভাবতে পারে না যে এজন্যই স্বাধীন তার স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পেরেছে। তার নিজের চেয়েও স্বাধীন তাকে অনেক ভাল করে চিনেছে। রিয়ানা এটাও জানে না যে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা তার চেয়ে ঢের কম করা স্বাধীন আসলে অনেক বড় কূটনীতিবিদ, যে কূটনীতির সফল প্রয়োগে স্বাধীন নারী বহু শতাব্দী পূর্বেই হয়েছে পরাধীন।


Check Also

মনুষ্যত্ব

প্রাণ থাকলে প্রাণী কিন্তু মন না থাকলে মানুষ নয়। আর এই মন ই হচ্ছে মনুষ্যত্ব। …

Leave a Reply

Your email address will not be published.