‘জামায়াতের নেতৃত্বে মানুষ আস্থা রাখবে না’—ধারণা উপদেষ্টা নাহিদের

: ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমার ধারণা, জামায়াতের নেতৃত্বে মানুষ আস্থা রাখবে না। তাদের ঐতিহাসিক ভুলগুলো জনগণ মনে রেখেছে। তাছাড়া ইসলামিস্ট রাজনীতিতে মানুষের আস্থা নেই। এই রাজনীতির ভবিষ্যতও নেই বাংলাদেশে।’

সম্প্রতি ভারত ভিত্তিক স্বাধীন সাংবাদিক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের ভিজিটিং ফেলো অর্ক দেব এর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন তিনি।সাক্ষাৎকারটি স্বাধীন অনলাইন গণমাধ্যম ইনস্ক্রিপ্ট ডট মি-তে প্রকাশিত হয়েছে। অর্ক দেব এ গণমাধ্যমের সম্পাদক।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িটি ভাঙা কি সরকার আটকাতে পারতো না? এর প্রয়োজনীয়তা ছিল কিনা এমন প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। আমরা চাইছি দ্রুত নিষ্পত্তি। বিচারে প্রমাণ হয়ে গেলে আন্তর্জাতিকভাবে আমরা এগোতে পারব। ভারত সরকার শেখ হাসিনা এবং বেশ কিছু আওয়ামী নেতাকে আশ্র‍য় দিয়েছে। তারা একটা ব্যখ্যা আমাদের দিয়েছে। তারা বলেছে, শেখ হাসিনাকে কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হবে না। সেই প্রতিশ্রুতি যথাযথ রক্ষা হচ্ছে না। বিচার হওয়ার আগে হাসিনার সমস্ত সক্রিয়তার ব্যাপারে আমরা ভারত সরকারকেই প্রশ্ন করব। গতকাল বিদেশ মন্ত্রণালয় এই নিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছে। ভারতের হাই কমিশনারকে তলবও করা হয়েছে। আমরা ভারত সরকারের থেকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীলতা আশা করছি। আওয়ামী লীগ বরাবর প্রচার করে গিয়েছে, তারা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে তাদের নেতাকর্মীদের খুন করা হবে। পাঁচ অগাস্টের পর থেকে আমরা বারবার মানুষকে সংযত থাকতে বলেছি। মানুষ মেনেও নিয়েছে আমাদের কথা। সেই সময় সরকার ছিল না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে কিন্তু পরিস্থিতি অন্য দিকে যেতে পারত। বহু আওয়ামী নেতা পালিয়ে গিয়েছে, গা ঢাকা দিয়ে আছে, তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছে। যারা নির্যাতন করেছে, নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ থাকবে, যতদিন নির্বাচন না হয়। ৩২ ধানমন্ডির ঘটনা এই বিক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি।’

শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙার সময় সেনাবাহিনী কেন ব্যবস্থা নিল না এ প্রশ্নে নাহিদ বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলা বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করলে ঘটনা আরও হঠকারী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো। তারা চেষ্টা করেছে ক্ষোভ প্রশমনের। কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। রাজনৈতিক উস্কানি দেওয়া হয়েছে এখানে। এখন বিষয়টা যাতে আর না ছড়ায়, সরকারের তরফে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

সরকার বা উপদেষ্টারা ‘মব জাস্টিস’ সমর্থন করছেন কিনা এমন প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘না করছি না। আপনাকে বুঝতে হবে, এটা অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি। এই সময় মানুষের মধ্যে সমাজ-মনস্তাত্বিক ট্রমা থাকে। তাদের শুশ্রূষা দরকার হয়। স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। আমরা কোনও ঘটনাকে প্রশ্রয় দিইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে আমরা জড়িতদের গ্রেফতারির ব্যবস্থা করেছি। আমরা সবাইকে সচেতন হতে অনুরোধ করছি। আরেকটা কথা মাথায় রাখবেন, বাংলাদেশে পুলিশ ব্যবস্থা এখনও সক্রিয় নয়, আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এখনও স্বাভাবিক নয়।’

পুলিশ প্রশাসনে আওয়ামী লীগের নিয়োগকৃত লোক থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, ‘হাসিনা শাসনকালে সব প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণ হয়েছে। প্রথম স্তরটা বাদ দিলে, দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরেও তাদের লোক আছে। আবার ধরুন যাদের বঞ্চিত করা হয়েছে, যাদের এখন পদোন্নতির ব্যবস্থা হয়েছে, তাদের অনভিজ্ঞতা রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন থেকে বহু পুলিশকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার করা হয়েছে, অনেককে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে, আবার কয়েকজনকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু যিনি এসেছেন তিনি তো শহরটাই চেনেন না, এত বড় শহর, এত অপরাধ হয়, ফলে তার কাছে এখন খুব বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে বেশিরভাগই ক্ষমতার বক্ষলগ্ন হয়ে থাকতে চায় এবং যেহেতু তারা মনে করছে এই সরকারটা অল্প দিনের, দলীয় সরকার তৈরি হবে, তাই তারা এখন থেকেই সেই দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজিকে অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।’

একাত্তরের ধারাবাহিকতায় চব্বিশের চেতনাকে ধারণ, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী অবস্থানের পরও জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়া জামায়াতে ইসলামীকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ পরবর্তীতে এতকাল পরেও ইচ্ছে করেই জামায়াত ইস্যুটা প্রাসঙ্গিক করে রাখা হয়েছে। যে কোনও বিরোধিতা বা আন্দোলনকেই জামায়াত–শিবির ট্যাগ দেওয়ার প্রবণতা ছিল। তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। জামাতের নেতৃত্ব এখন মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেই তাদের বক্তব্য দিচ্ছে। এই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে জামায়াতের কাফফারা হয়েছে। কিন্তু জামায়াতকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, একাত্তর মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে ভবিষ্যতে তারা রাজনৈতিক বিরোধিতা করবে না। একাত্তর বিরোধী অবস্থান নেবে না, এই নিশ্চয়তা তাদের দিতে হবে। এখন মূল নেতৃত্ব একাত্তর নিয়ে কথা বলছে না, কিন্তু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা নানা কথা বলে বিতর্ক চালাচ্ছে। আবারও বিভাজনের রাজনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। একাত্তর আমাদের ভিত্তি। এটাই শেষ কথা। একাত্তরের পক্ষ ও বিপক্ষ নির্মাণের রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা পঞ্চাশ বছর পার করে ফেলেছি। কিছু বিচারও হয়েছে। তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু জামায়াত অনুসারীদের একাত্তর বিরোধিতার জন্যে বিচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের তো এখনও বিচারও হয়নি।’

আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া কিনা বা নিষিদ্ধ করার দিকেই এই সরকার এগোবে কি না এ প্রশ্নে নাহিদ বলেন, ‘কাদের সঙ্গে সংলাপ করব তার তো একটা সীমা আছে। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ সেই ফ্রেমওয়ার্কেই আসে না। ওরা বাকশাল করেছে। জুলাই গণহত্যা ঘটিয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও অনুশোচনা নেই ওদের। তারা জুলাই বিপ্লবকে স্বীকৃতি দেয়নি। ক্ষমা চাইলে তো পুনর্বিবেচনা! আমরা কিন্তু নিষিদ্ধ করার কথা বলিনি শুরুতে, কিন্তু ছাত্রলীগ মিছিল, গুপ্তহত্যা শুরু করল। শহীদ পরিবারের ওপর মামলা করছিল ওরা। এটা এখন জননিরাপত্তার বিষয়। আমরা বিচারপ্রক্রিয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। দল হিসেবে ওদের ভূমিকা প্রামণিত হতো এর মাধ্যমে। আমরা চাইলে ৮ আগস্টেই নিষিদ্ধ করে দিতে পারতাম ছাত্রলীগকে। কিন্তু ওরা এই সুযোগে সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চাইছে। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের মতাদর্শ ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ। এই মতাদর্শ বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছে। এই মতাদর্শকে আর সুযোগ দেওয়া উচিত না, বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণও করবে না। তবে আওয়ামী লীগের যে নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন না, তাদের নাগরিক অধিকার যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তা দেখতে হবে। আমাদের দেখতে হবে, বিরোধী হলেই যেন আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে দেওয়া না হয়, যেমন আগে উল্টোকথা বললেই জামাত শিবির ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হতো। আমরা চাই যারা নির্দোষ তারা সমাজে শান্তিতে বসবাসের অধিকার পাক।’

হাসনাত আবদুল্লাহ ভাঙার কথা বলছেন, বিপরীতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গড়ার কথা বলছেন। এটি কি ক্ষমতার লড়াইয়ের পূর্বাভাস? এমন প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘মাহফুজ আলম সরকারের জায়গা থেকে দায়িত্বশীল বক্তব্য দিয়েছেন। আবার ভাঙতে না জানলে আমরা গড়তেও পারব না। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই এই সময়টা যাবে। এটুকুই বলব। নানা ঘরানার মানুষ ছাত্রদের ব্যানারে এসে জড়ো হয়েছেন। সবাই একমতের হবে না এটাই স্বাভাবিক। আমরা একাত্তর আর চব্বিশকে ধারণ করেই বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই।’