
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। আমার শোবার ঘরের অদূরে একটি বকুল গাছে ফুল ফুটেছে। বকুল ফুলের গন্ধে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সৌরভ স্নাত থাকে যেন সমীরণমায়া। হঠাৎ সেদিন দেখতে পেলাম কে যেন আমার ছোট নামটি বকুল ফুলে লিখে গেছে গাছের তলায়। চারিপাশে ফুল ঝরে যেন পুষ্প গালিচায় রূপ নিয়েছে। তারই মাঝে লেখা নাম তন্ময়। দেখে আশ্চর্য হলাম। এত ভোরে কে লিখে গেল আমার নামটি? প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম না মনের কাছে। সেদিন উৎসুক হয়ে আবার ভোরে বকুলতলায় গিয়ে দেখলাম, খঙঠঊ প্রতীকের ঠিক মাঝখানে লেখা নাম তন্ময়। ফুল কুড়াতে কয়েকটি ছোট টোকাই মেয়েকে দেখলাম। বারণ করলাম- এই লেখা নামের ফুলগুলো কুড়িয়ে নিস নে।
যমুনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে আমাদের উত্তর সারিয়াকান্দি এলাকার কয়েকটি অভিজাত গ্রাম। ‘প্রয়োজন উদ্ভাবনের জনক’। তাই আমার বাবা-চাচা-জ্যেঠা সহ প্রতিবেশী অনেকেই সৈয়দ আহমদ কলেজ স্টেশন এলাকার একটি জনশূন্য এলাকাকে প্রায় শহরে রূপান্তর করেছে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। আমার দুই চাচাতো বোন, একজন জ্যেঠাতো বোন এবং প্রতিবেশী বেশ কয়েকজন সমবয়সী মেয়ে এলাকার একটি বালিকা বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। বিকেল বেলা অনেকেই দল বেঁধে কখনো পশ্চিমে, কখনো দেিণ সরিষা ফুলের জমিতে আবার কখনো রেল সড়কে পায়চারী করে ওরা প্রতিনিয়ত। কিছু অতি উৎসাহী এলাকার ছেলেরাও যে তাদের দূর থেকে টিজ করে না এমন নয়। তবুও নিত্য দিন তাদের এমন পথ চলা।
আমি এইচ.এস.সি পরীার্থী। ইচ্ছা থাকলেও অন্যান্য ছেলের মত খেলার মাঠে অথবা সন্ধ্যাবেলা পায়চারী করতে পারি না। পড়ন্ত বিকেল সূর্যাস্তে নীলিমা দেখা আমার খুব শখ। আমার পড়ার ঘরের পূর্বদিকের বড় জানালায় বসে সারাণ শুধু বই আর বই পড়ছি। মাঝে মাঝে মা এসে কিছু পছন্দের খাবার দিয়ে যায়। বিকেল থেকে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা আসে। সব আনন্দ উল্লাসের অন্ত টেনে সকলে ঘরে ফেরে, পাঠে মন দেয়। এস.এস.সি ফলাফল মন্দ করি নি। এইচ.এস.সি ভাল করে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে এটাই আমার আশা। তাই সাধনার সময় পার করছি নিরানন্দে।
পরীার সময় ঘনিয়ে আসছে। ভোর রাতে উঠে পড়তে বসি। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে যখন শুনতে পাই ‘আস্সালাতু খাইরুম মিনান নাওম’ তখন কি এক অমৃত বাণী আমার হৃদয়পটে জোয়ার জাগায়। শামসুর রাহমান, তছলিমা নাছরিন, সালমান রুশ্দী, হুমায়ুন আজাদ কেন যে আযানের সুর বিরক্তির মনে করত চিন্তা স্থির করতে পারলাম না। এ যেন অমৃতে অরুচি। হঠাৎ মনে হল আজ দেখব আমার নামটি বসন্ত ভোরে এমন আদর করে লিখে যায় ঊষার আলো বসুন্ধরায় পৌঁছার পূর্বেই। চুপি চুপি কাছে গেলাম। বারান্দার খুঁটির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, একান্ত মনে খুব তড়িঘড়ি করে তন্ময় নামটি লিখে চলেছে। আরো ধীরে ধীরে ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লেখা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম। অমনি ফিস্ ফিস্ করে কান্না। চোখে চোখ রাখতেই অন্ধকার আভায় যে সোনার মত মুখখানি আমার নজরে পড়ল- তাকে সারা জীবন ভালোবাসা যাবে, আদর করা যাবে কিন্তু বিয়ে করা যাবে না। কারণ………………
পরদিন ভোর থেকে সারাদিন আল্পনার তুলিতে তন্ময় লেখা আর্টটির শিল্পী নিশাতকে আর পাওয়া গেল না। বিকেল বেলা পুকুর ঘাটে নারিকেল গাছের সারির সম্মুখে যাকে প্রতিদিন দেখলাম আজ সে স্থান যেন খাঁ খাঁ করছে। কয়েকটি দূর সম্পর্কের বোন, ভাগ্নি, ফুফিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও তাদের ফাকে লোচন যেন খুঁজে ফিরছে নিশাতকে। বুঝতে পারলাম বড় লজ্জা পেয়েছে সে। মনকে প্রশ্ন করলাম, পাখি কেন হলাম না? ভালো লাগলে ঘর করতে পারতাম, বাসা বাঁধতে পারতাম, তারপর ডিমে পালাক্রমে তা, তারপর ইত্যাদি ইত্যাদি………….। ছিঃ এগুলো কথা আজ আমার ভাবাও পাপ। শুধু শুধু পড়া নষ্ট করছি। বুঝতে পারছি দিবারাত্রি দারুণ তৃষ্ণায় হৃদয় পুড়িতেছে। সম্মুখেই শীতল জল। কিন্তু ইহ জনমে সে জল পান করিতে পারিব না। কারণ সমাজ এবং বৈরী সম্পর্ক বলে কথা!
এইচ.এস.সি পরীার আর তিন দিন বাকি। কলেজ থেকে বিদায় নিয়েছি। প্রতিবেশী অনেকের কাছেই দোয়া নিতে গেলাম। কেউ কলম দিয়ে, কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে, কেউ রুমাল হাতে দিয়ে আশীর্বাদ করতে লাগল। অনেক চাচাতো, ফুফাতো বোনেরা চকলেট দিয়ে হাসিভরা মুখে আমার নিকট থেকেই দোয়া আদায় করে নিল। এইবার জিলাদার বাড়ি। আশেপাশে কেউ নেই। বকুল গাছটিতে ফুল আছে কিনা না দেখেই সংকোচে গেট পার হলাম- ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’। শুন শান নিরবতা, ডাকলাম, ভাবি কেউ কি আছেন? কেউ কথা বলল না। দরজা খোলা দেখে ঘরে প্রবেশ করলাম। নিশাতের পড়ার টেবিলে চোখ রাখতেই কি যেন লুকানোর চেষ্টা করল সে। আমি কাছাকাছি গিয়ে বললাম, নিশাত, আমার জন্য দোয়া করো। আমি আজ পরীা দিতে যাচিছ। নিশাত তার গায়ের সাদা ওড়নাটা আমার হাতে দিয়ে বলল, এই নাও আমার দোয়া। তুমি ভালো পরীা দাও। রুমাল মনে করে ওড়নাটা হাতে নিয়ে দেখি রক্তে ভেজা। ওতে লেখা- ‘তোমাকে ছাড়া মরতে চাই’। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনো আঙুল থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। আঙুলটি চেপে ধরে স্থির চোখে তার দিকে কিছুণ তাকিয়ে থাকলাম। নিশাতও চোখ ফেরাল না। তারপর দু’হাতে ওর চোয়ালটা ধরে মুখটি ওর মুখের কাছাকাছি নিতেই বাইর থেকে ভাবি ডাকল, নিশাত বেরিয়ে দেখ কে এসেছে? বাবার আদরের নিশাত বাবার কাছে চলে গেল। আমি আবার প্রতিবেশী ফুফীর বাড়ি হয়ে একেবারে রেল স্টেশন তারপর গন্তব্য পরীা সেন্টার।
পরীা শেষ। প্রাকটিক্যাল পরীার জন্য আরো দুই দিন খাটতে হবে। হঠাৎ রুমের সামনে দাড়িয়ে দেখি একটি বড় এবং একটি ছোট হাত ব্যাগ নিয়ে নিশাত আমার রুমের দিকে আসছে। আমি তো হতবম্ব হয়ে গেলাম। রুমমেটকে বুঝতে দিলাম না। ব্যাগগুলি নিয়েই একটু দূরে রেল স্টেশনের নির্জন স্থানে গিয়ে বসলাম। তখন গোধূলী বেলা। সূর্য লাল রং ধারণ করেছে কিন্তু ধরণীর মায়া এখনো ছাড়ে নি। নিশাত আমার হাত ধরে বলল, তন্ময় তুমি আমার হাতটি শক্ত করে ধরো। ধরো না কেন? দেখ তোমাকে আমার খুব বেশি ভালো লাগে। তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। জানো, অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে থাকার। কিন্তু যতবার ভোলার মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস ততবার যেন হয়েছে আমার অনার্থ পরাজয়। তাই জয়ের আশায় তোমার কাছে ছুটে এসেছি তন্ময়। প্লিজ আমাকে ফিরে দিও না। আমি বললাম, দেখ তোমার সোনার মত মুখ আর তোমার মায়াবী ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু বৈরী সম্পর্ক বলে তো একটা কথা আছে। জানো, তুমি সম্পর্কে আমার …………
সে কথা অনেকবার ভেবেছি। কিন্তু সে ভাবনার সাগরের কিনারা খুঁজে পাই নি। দেখ, তুমি তো আমার রক্তের কেহ নয়। শুধু বানানো সম্পর্ক। তবুও নিশাত সমাজ বলে একটা কথা। কেউ মেনে নেবে না। সকলেই পরদিন কানাকানি করবে- আমরা অবৈধ সংসার করছি। নিশাত আমার মুখে হাত চেপে বলল, আর বলো না, তাহলে চলো ৩৫ বছরের বাবার পছন্দের ঐ বৃদ্ধের সাথেই তুমি নিজ হাতে আমাকে তুলে দাও। তারপর পরের দিন দেখতে এসো আমার নি®প্রাণ দেহ।
কি করব ভেবে পারলাম না। সবে এইচ.এস.সি পরীা দিচ্ছি। সম্মুখে অনেক পথ। নিশাত এস.এস.সি পরীার্থী। এ যেন ছোট বাচ্চাদের ধূলিবালির অট্টালিকা। নিশাতকে আমার প্রচন্ড ভালো লাগে। কিন্তু ওর সামনে বলিনি কখনো। ওর চোখ দুটোর দিকে তাকালে মনে হয়, ও যেন স্রষ্টার নিজ হাতের তৈরি। ভূবন ভুলানো দুটি কপোল সে তো স্বর্গীয় পরীর। আর তার হাসিতে যেন ইন্দ্রের অপ্সরীরাও লজ্জা পায়। তাই আদর করে ছোটবেলায় ডাকতাম শুচিস্মিতা বলে। আর সে ডাকই নাকি তার সর্বনাশ করেছে। নিশাতের দু’চোখে সমুদ্রের জল পড়ছে। মাথাটা ততণে আমার কোলের ওপর দিয়ে অশ্রু ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অশ্রুসিক্ত চোখ দেখেই আর কিছু বলতে পারলাম না। বললাম চল, কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করি। রুমমেট বন্ধুটাকে ডাকলাম। ও চলে এল। পকেটে মাত্র এক হাজার পঞ্চাশ টাকা। এই নিয়ে শুরু হবে আমার সংসার। কাজী অফিসে বসে নিশাত কাবিননামায় সই করেছে, আমি কলম হাতে নিয়েছি। তন্ময় শব্দের ত বর্ণটি শেষ না হতেই আর কোথায় যাব? চিল পাখি যেন ছো মেরে মুরগির বাচ্চা নিয়ে যায় তেমনই আমার বাহুডোর থেকে নিশাতকে ওর বাবা, মামা, ভাই ছিনিয়ে নিয়ে গেল। বাধা দিতে গিয়ে দু’চারটি কিল-ঘুষি খেলাম না এমন নয়। যাবার বেলায় হুমকি দিয়ে গেল, তোর আয়ু দশ দিনের বেশি নেই। খেয়ে নিস্।
আমার কথা চিন্তা করলাম না। কিন্তু নিশাতের কোমল শরীরে ওরা যদি আঘাত করে, তবে ভেবে খুব কষ্ট পেলাম। ওরা তো নিশাতকে বিয়ে দিবেই। পরদিন যদি দেখি নিশাতের প্রাণশূন্য দেহ তখন কেমন লাগবে আমার?
খোদার কৃপায় ঢাকায় ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স থেকে মাস্টার্স করেছি। ইতিমধ্যেই দুটি উপন্যাস লিখে খ্যাতি অর্জন করেছি। কচিকাচার আসরে কৌতুকপূর্ণ ছড়া লিখে ঢাকার ুদ্র বিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মণিকোঠায় উঠে গেছি তা একটি অনুষ্ঠান থেকে বুঝে গেলাম। অনেক বিদ্যালয় এবং কলেজের ছেলেমেয়েরাই এখন আমার বই পড়তে উৎসাহী। লিখে চলেছি জীবনের কথা, লিখে চলে অজানার কথা, লিখে চলেছি স্বয়ংবরার কথা। ভক্তরা জুটেছে অনেক। ‘জীবনের অন্য নাম’ একটি বই লিখে যখন দেশ জোড়া খ্যাতির আসন লাভ করলাম তখন স্বদেশের নিজ শহরেই শুনতে পেলাম আমার সংবর্ধনার এক বিশাল আয়োজন চলছে।
মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। ভক্তদের নানা প্রশ্নের উত্তর শেষ হলো। উৎসুক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পালা এবার। আমাকে অটোগ্রাফ, আমার ডায়েরীতে, আমার খাতায় ইত্যাদি ……….। হাসিমুখে কারো চুল ধরে, কারো কান ধরে, কারো বা নাক ধরে আদর করছি। হঠাৎ একটু দূরে চেয়ে দেখি কে.জি স্কুলে পড়া একটি ছোট মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন সদ্য অভিভাবক। মেয়ের হাতে খাতা নিয়ে অপো করছে হয়ত। মেয়ের অনুরোধেই হয়ত এসেছে এতদূর। ভিড় ঠেলে ছোট মেয়েটির কাছে গেলাম। খাতায় লেখার পূর্বেই চোখে চোখ পড়ল যার উপর তা আর অনুমান করতে ভুল হল না। সে আমার বকুল ফুলে লেখা নামের কারিগর শুচিস্মিতা।