হোসনে আরা মণি
পুংঃ এই শুনছো? ওরা বুঝি শুতে এলো।
স্ত্রীঃ হুম, শুতে দাও এবং ঘুমাতে দাও। হাভাতের মত ঘুম না জমতেই ঝাঁপিয়ে পোড়ো না।
পুংঃ হাভাতে বলছো কেন গো! আমরা কি আর ভাত খাই!
স্ত্রীঃ ঐ হোলো হারক্ত, হালহু, হাখুন……
পুংঃ তুমি কত বিদ্যান গো, থুড়ি, বিদুষী……
স্ত্রীঃ ওদের ভাষায় কথা বোলো না। ওসব লিঙ্গভেদ আমাদের মধ্যে নেই।
পুংঃ নেই কি গো! তুমি স্ত্রী, আমি পুং……
স্ত্রীঃ প্রলাপ বোকো না। স্ত্রী-পুরুষ ব্যাপারটা বায়োলজিক্যাল, তাই বলে শব্দের ব্যবহার দিয়ে সেই পার্থক্য মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন কী?
পুংঃ খ্যামা দাও। আর অমন বলব না।
স্ত্রীঃ সুন্দর ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করো। আমার সাথে কোন ত্যাড়াবাঁকা কথা নয়।
পুংঃ ত্যাড়াবাঁকা আবার কী বললুম? বললুম তো ক্ষমা করতে।
স্ত্রীঃ সেটাই ঠিকঠাক শব্দচয়নে, নির্ভুল বাক্য গঠনে বলতে পারতে।
পুংঃ ঠিক আছে তাই বলছি। ক্ষমা করো আমাকে। আর কখনো তোমাকে বিরক্তিকর কিছু বলব না।
স্ত্রীঃ বেশ। এবার ওদের দিকে মন দাও। এই যে বাতি নিভল।
পুংঃ ইস্! খিদেটা পেটে কেমন মোচড় দিয়ে জাগছে। আহা! কতদিন পেট ভরে খেতে পাইনে!
স্ত্রীঃ সাধে কি আর তোমাকে হারক্ত বলতে হয়! এই তো তিন রাত আগে দিব্যি পেট ফুলিয়ে খেলে।
পুংঃ সে কি আর পেটে আছে গো? গত তিন রাত তো ওষুধের ভয়ে বেরুতেই পারছি না।
স্ত্রীঃ হুম, মিছেই মশা ভেবে ওরা স্প্রে করছিল। কেমন বিদঘুটে এক গন্ধ তাতে। এই বাঙ্গালগুলো যা বোকা না! কামড়ের পার্থক্যও ধরতে পারে না।
পুংঃ ব্যাপার কি বলো তো? আজ যে ওরা স্প্রে না করেই ঘুমিয়ে পড়লো! শোনো, কেমন নাক ডাকছে!
স্ত্রীঃ বুদ্ধুরাম তো তুমি, তাই বুঝতে পারোনি। তোমার কি নাক বলেও কিছু নেই? ঘরে যে আজ একটা লোক কম তা গন্ধেও বোঝোনি? যে লোকটা একটু গা চুলকালেই ফস করে স্প্রে করছিলো সে আজ নেই। এই সুযোগ। সব্বাইকে জাগিয়ে তোলো। ছেলেপিলেদের ডাকো। ওদের মাসী-পিসি-খুড়ো-জ্যাঠা যে যেখানে আছে ডাক দাও। আজ ভোজ উৎসব হবে।
পুংঃ আগে চলো তুমি-আমি একটু চেখে আসি। তারপর গোত্রের সকলকে খবর দেই।
স্ত্রীঃ স্বার্থপর! সুবিধাভোগী! এজন্যই তোমাদের ওখানে বিপ্লব ফেল মেরেছে।
পুংঃ আর তোমরা বুঝি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে ফেলেছ?
স্ত্রীঃ এটা অনেক বড় রাজনৈতিক ব্যাপার। তোমার মত আদার ব্যাপারীর সাথে ও আলোচনা বৃথা।
পুংঃ চিরকাল কি আমাকে এমন হেলাছেদ্দা করবে গো? স্বামী হিসেবে একটু সম্মানও কি…….
স্ত্রীঃ চুপ করো! স্বামী কী? তুমি আমার সঙ্গী মাত্র। আমাদের সমাজে ঐ দুপেয়েদের মত স্বামীগিরির ব্যাপার চালু নেই। তুমি কি ওদের রক্ত খেয়ে খেয়ে ওদের বিধান আমাদের সমাজে চালু করার স্বপ্ন দেখ?
পুংঃ কী যে বলো! তাই কি হয়! তবে ওদের কথা শুনে শুনে একটু ওদের মতো করে বলতে-কইতে ইচ্ছে করে আরকি। শুনছিলে না, কাল সেই লোকটা কেমন বলছিল, আমি স্বামী……
স্ত্রীঃ হুম, সে যা বলে তাই ঠিক, যা করে তাই অন্যকে মানতে হয়। না মানতে চাইলেই হুমকি-ধামকি। অমন স্বপ্ন তুমি দেখো না যেন।
পুংঃ দেখবো না। তুমি যা বলবে আমি চিরটিকাল তাই মেনে চলবো। এখন খেতে চলো তো জানু। ঐ শোনো ওদের নিঃশ^াসের শব্দ কেমন গভীর হয়েছে। আর গন্ধটা কি খাসা মাইরি!
স্ত্রীঃ সেই বদগন্ধ গায়ের লোকটা নেই যে। আজ এরা সব খুশবুদার মাল।
পুংঃ ওহ্! কেমন মিষ্টি কচি কচি গন্ধ! আজ আমি পেট পুরে খাবো। এমন খাবো যেন আর জীবনেও খিদে না পায়।
স্ত্রীঃ তাই হবে শেষে। এমন মরণ খাওয়া খাবে যে মদো মাতালের মত ওখানেই পেট ফুলিয়ে পড়ে থাকবে। তারপর সকালে ওরা তোমায় দেখতে পেয়ে এক টিপে পেট গেলে দেবে। খবরদার বলছি, সেদিনের মতো নাটক কোরো না। আমি এই বুড়ো বয়সে তোমাকে বয়ে আনতে পারব না তা বলে দিচ্ছি।
পুংঃ বুড়ো কি বলছো গো! তোমার গায়ে এখনো যা জোর! আমার দেশের মেয়েদের মতো তুমি তো আর লুতুপুতু না……
স্ত্রীঃ যতই তেল দাও, লাভ নেই। কদিন ধরে আমার সারা শরীরে ব্যথা।
পুংঃ তুমি তাহলে আমাকে একটু কন্ট্রোল কোরো সোনা। জানোই তো, আমার সংযম কম।
স্ত্রীঃ সে আর বলতে! জীবনভর তোমাদের ‘কন্ট্রোল বেল্ট’ মিছেই আমাদের হাতে ঝুলে থাকে। ঐ জিনিস আমাদের হাতে তুলে দেয়ার নামে কী প্রেমই না তোমরা দেখাও! আবার তোমাদের দরকার মতো কখন যে বেল্ট কেটে নিয়ে পালাও!
পুংঃ অতটা অবিশ্বাস কোরো না জান। এই আমি আমার মরা মায়ের দিব্যি কেটে বলছি, জীবনে কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।
স্ত্রীঃ অমন ছারুও বলতো। আমি একটু মুখ ঝামটা দিলেই পায়ে পা জড়িয়ে বসে রাতদিন কাঁদতো। অথচ ঝগড়া-ঝাঁটি কিচ্ছু না, এক সিজনে গ-া কয়েক আন্ডা পাড়িয়ে দিয়েই সে একদিন হাওয়া!
পুংঃ আমাকে তার সাথে তুলনা কোরো না গো, দিলে বড় চোট পাই।
স্ত্রীঃ হয়েছে! অমন কত ন্যাকামো দেখলাম এ জীবনে! পুরুষের মুখের মধুতে আর এ পোড়া মন গলে না। তার উপর তুমি বাঙ্গালী বাবু, বুদ্ধির বলিহরি। দু’পেয়েদের সুটকেসে লুকিয়ে ভ্রমনের নামে এই দক্ষিণ দেশে এসে জুটেছ, তারপর আমার মতো সুন্দরী বাগিয়ে……
পুংঃ হে হে হে, তা আর বলতে! দেখো না, তোমায় কেমন সুন্দর বাংলা বুলিও শিখিয়ে ফেলেছি। কথা-বার্তায়-চালচলনে তুমি খাঁটি বাঙ্গালী বঁধূ।
স্ত্রীঃ ফের! ফের তুমি আমায় বঁধূ বলছো!
পুংঃ থুড়ি, থুড়ি, বঁধূ না বঁধূ না, বান্ধবী, থুড়ি, প্রেমিকা, নাহ্, মনের মানুষ, জীবনসঙ্গী, অর্ধাঙ্গী, বেটার হাফ……
স্ত্রীঃ সে তুমি মুখে যাই বলো, অন্তরে কী ভাব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যাও, এখন তাড়াতাড়ি সবাইকে জাগিয়ে তোলো। দেখো, কেউ যেন বাদ না পড়ে। কেউ খাবে, কেউ খাবে না, এমন হওয়া উচিৎ না।
পুংঃ এই তোরা সব ওঠ রে! দেখ, কী খুনসুবাস! ওরে, তোরা জাগ রে!
(২)
দেখেন, আপনাদের হোটেলে উঠে আমাদের কী দুর্দশা! সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারি নাই……
হোয়াট হুয়া ম্যাডাম?
হোয়াট হুয়া? ব্যাটা ভোঁদড়! না জানে ঠিকঠাক ইংরেজি, না হিন্দি। বাংলাতো বোঝে না এক বর্ণও। কী করে যে বোঝাই!
আপ কুচ বলিয়ে?
নাথিং বলিয়ে। ইউ জাস্ট সী, মাই ডটার, মাই ডটারস্ লেগস্, হ্যান্ডস্, সী হার ব্যাক….. দিজ রেড স্পটস…..
ওহ্ ম্যাম, দিজ আর এলার্জি, এলার্জি স্পটস…..
তোমার মাথা! সারারাত আমার মেয়েটাকে ছারপোকায় খেয়েছে। হেই, ডু ইউ নো বাগস্? বেড বাগস্? ডোন্ট ইউ নো দেম?
বাগস্! হোয়ার ম্যাডাম? হোয়ার বাগস্? মি দেখিয়ে……
এই বিছানায় ভরপুর আছে। উল্টালেই দেখতে পাবে। জাস্ট টার্ন ওভার দিস বেড……সী, দিস ইজ ওয়ান,রেড-ব্রাউন, ফিলড্ উইথ ব্লাড, বিয়িং সো ফ্যাট, ইট কান্ট মুভ অন….দিস ইজ এনাদার ওয়ান……লুক, লুক, দেয়ার আর মেনি……হায়! কাল কেন যে স্প্রে করে ঘুমালাম না! মশা না দেখে ভাবলাম মিছে কেন ঘর গন্ধ করা! ঐ গন্ধটা আমার একদম সহ্য হয় না। উনি যখন স্প্রে করতেন আমি নাকে কাপড় গুঁজে হাঁসফাঁস করতাম, তবু উনি বাচ্চাদেরকে মশা কামড়াবে বলে খুব করে স্প্রে করতেনÑ আসলে নিজেই মশার কামড় ভয় করেন কিনা….কই, এই ঘরে তো আমি কোনই মশা দেখিনি। কাল তাই উনি চলে যাওয়াতে আমি স্প্রে না করেই…..
হিয়ার ম্যাম, হিয়ার মি প্লিজ। হাম বাংলা মালুম নেহি। আই তামিল। জাস্ট নো লিটিল ইংলিশ, থোড়া ছে হিন্দি।
তা দিয়েই তো দিব্যি চালিয়ে খাচ্ছ বাবা। আয়-উপার্জনও মন্দ না। এই পায়রার খুপরির জন্য চব্বিশ ঘন্টায় ছ’শো রুপি। মুরগী খোয়াড়ে ঢোকার সাথে সাথেই একবারে পাঁচ দিনেরটা কষে নিচ্ছ। তারপর আর তো কোন সার্ভিসের বালাই নেই।……আবার চোখ গোল গোল করে চেয়ে থাকা হচ্ছে? লিসেন, মিঃ ম্যানেজার, উই আর ফ্রম বাংলাদেশ, হ্যাভ কাম সো ফার ফর আওয়ার চাইল্ডস্ ট্রিটমেন্ট। উই আর স্টেয়িং হিয়ার ফর হার গেটিং ওয়েল, নট ফর গেটিং এনি নিউ ডিজিস।
ডিজিস! ও নো, ম্যাডাম। নো ডিজিস হিয়ার। হিয়ার কাইমেট ইজ হট, বাট নো ডিজিস।
আরে বুদ্ধু! ডিজিস কোন দেশে নেই? তোমাদের এখানকার গরমে তেতেপুড়ে কাবাব হয়ে যাচ্ছি সে নিয়ে তো আর নালিশ করতে বসিনি। মরার উপর মরছি ছারপোকার যন্ত্রণায়, সেটাই দেখ না বাবা। হোটেল চালায় দিব্যি ভাল-মন্দ খাচ্ছিস, আর আমাদের খাওয়াচ্ছিস ছারপোকা দিয়ে?
বাংলা মালুম নেহি ম্যাডামজি……
মালুম নেহি তো মঙ্গল হ্যায়।
(৩)
অল কিয়ার ম্যাডামজি, অল বাগস্ মে মার ডালা, আপ ডর নেহি হোতা…..
ভেলোরের থোট্টাপুলায়াম রোডের অরপুত্থাম লজের ম্যানেজার মিসেস হোসেনকে দিগ্বিজয়ী হাসির সাথে খবরটা দেন।
‘হয়েছে বাবা, ওষুধ ছিটায়ে কয়টা ছারপোকা মেরে যে হাসি দিচ্ছ বখতিয়ার খিলজি গৌড় জয় করেও বোধহয় সে হাসি হাসতে পারেন নি।’ মিসেস হোসেন মনে মনে ভাবেন। মুখে আর কিছু না বলে উঠে তার ঘরের দিকে যেতে যেয়ে দেখেন কিনার মেয়েটা বিরক্তি ও বিবমিষা মাখা মুখে সতর্ক হাতে একটা বেলচা তুলে ধরে তার ঘর থেকে বের হচ্ছে। কাছাকাছি এসে তিনি যা দেখেন তাতে তারও কেমন বমি বমি বোধ হয়। হলদে প্লাস্টিকের বেলচার পরে অগণিত লালচে খয়েরি অবয়ব চিৎ হয়ে পড়ে কিলবিলিয়ে নড়ছে। কিছু দেহ ছোপ ছাপ রক্তের মধ্যে গলে পড়ে আছে। এসব রক্ত তার ও প্রাণপ্রিয় সন্তানদের। তবু মানবদেহ থেকে বিসর্জিত যে কোন পদার্থই মানুষের চোখে অপ্রীতিকর, ঘৃণা উদ্রেককর, এমনকি হোক তা প্রিয়জনের। তাই সৌন্দর্যপিপাসু মিসেস হোসেন একটু শিউরে উঠেই চোখ সরিয়ে নেন। কিন্তু তার শিল্পী অন্তর দেখতে পায় চিরন্তন লোলুপতার পরিণাম। জগৎ ও জীবনের নানা অধ্যায়ে ঘটে চলা অগণিত রক্তাক্ত প্রান্তরের মতোই এখানেও একই অপরিমিত অসংযমী অনিয়ন্ত্রিত খাই খাইয়ের করুণ পরিণতি।